খোঁজের রহস্য
রাত গভীর। কলকাতার আকাশে বৃষ্টি নামার আগেই একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। শহরের প্রাচীন এক অন্ধকার গলিতে দাঁড়িয়ে ডিটেকটিভ অর্ণব চ্যাটার্জি সিগারেটে টান দিতে দিতে একটা মৃত্যু নিয়ে ভাবছে। খুন নাকি আত্মহত্যা—এই প্রশ্নটাই এখন সবচেয়ে বড় রহস্য।
অমিতাভ রায়, এক বিখ্যাত চিত্রশিল্পী, খুন হয়েছেন নিজের স্টুডিওর মধ্যে। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, জানলাগুলো লক, বাহিরের দিক থেকে কোনো জোর করে ঢোকার চিহ্ন নেই। অথচ, তিনি চেয়ারে বসে, বুকের মাঝে ছুরি গেঁথে মারা পড়ে আছেন। মুখে যেন একটা অপেক্ষার ছাপ, চোখ দুটো খোলা। যেন কাউকে চেনা কারো জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
খুনের সন্ধ্যায় স্টুডিওতে ছিলেন মাত্র কয়েকজন—স্ত্রী নন্দিতা, ছাত্র বিপ্লব, বন্ধু তাহমিদ, আর্ট ক্রিটিক রেশমী, পার্টনার দেবজ্যোতি আর একমাত্র পরিচারিকা রিয়া। প্রত্যেকেই নিজেকে নির্দোষ বলছে, প্রত্যেকেই সেই মুহূর্তে ‘অন্য কোথাও’ ছিল।
কিন্তু অর্ণব জানে, খুনি তাদের মধ্যেই আছে।
ঘটনার তদন্ত শুরু হতেই কিছু টুকরো সত্য ভেসে উঠল। অমিতাভের হাতের মুঠোয় ধরা ছিল একটা ছেঁড়া কাগজ—তাতে লেখা ছিল শুধু একটা অক্ষর: "R"। প্রায় সবাই ভাবল রেশমী হতে পারে। তার সঙ্গে অমিতাভের সম্পর্ক সব সময় ঠান্ডা ছিল, এবং তিনি খুনের সময় একা ছিলেন পাশের রুমে। কিন্তু অর্ণব এত সহজে বিশ্বাস করে না।
রিয়ার চোখ ছিল নিঃশব্দ। সে কাজ করত, কথা বলত না। সবাই তাকে উপেক্ষা করত। কিন্তু তৃতীয় দিন সে অর্ণবকে কাছে ডেকে বলল, “স্যার, রেশমী ম্যাডাম ছবি উল্টে দিয়েছিলেন খুনের আগেই।” অর্ণবের মনে সন্দেহ জাগল। সে ছবিটার দিকে ছুটে গেল। দেওয়ালে টাঙানো ছবির ফ্রেমের পেছনে একটা কাগজ খুঁজে পেল। তাতে লেখা ছিল: "আমি যাকে বিশ্বাস করেছিলাম, সেই-ই আমায় শেষ করবে। রিয়া কিছু জানে না, সে শুধু এক মুখোশ, আসল খেলা অন্য কারও।"
অর্ণব এবার নতুন করে ভাবল। রিয়া নয়, রেশমী নয়। সে আবার প্রত্যেকের অতীত ঘেঁটে দেখল। তাহমিদ হঠাৎ বিদেশ থেকে ফিরে এসেছে। দেবজ্যোতি স্টুডিওর ফাইনান্স দেখে, কিন্তু তার হিসেবেও গলদ ছিল। বিপ্লব অমিতাভের ছাত্র হলেও সম্প্রতি তার নিজস্ব গ্যালারি খোলার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু এসবই ছিল খোলস।
হঠাৎ করে অর্ণবের মনে পড়ল এক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য—নন্দিতা, অমিতাভের স্ত্রী, একসময় নিজেও শিল্পী ছিলেন, কিন্তু বিয়ের পর সে ছবি আঁকা ছেড়ে দেয়। তার কাজগুলো কখনো আলোচনায় আসেনি, অথচ তার কিছু আঁকা এখন অমিতাভের নামে বিক্রি হচ্ছিল বিদেশে।
অর্ণব বুঝে গেল আসল কাহিনি। খুনের রাতে, নন্দিতা জানত অমিতাভ তার ছবি নিজের নামে বিক্রি করছে। রাগে-ঘৃণায় জ্বলছিল সে, কিন্তু চুপ করে ছিল। সেই রাতে, অমিতাভকে খুন করে সে এমনভাবে সাজায় যেন বাইরের কেউ ঢুকে খুন করেছে। ছুরি হাতে ছুঁইয়ে "R" লেখে—যাতে সন্দেহ পড়ে রেশমীর ওপর, কারণ তাদের মাঝে আগেই দ্বন্দ্ব ছিল।
নন্দিতা সবসময় নিজেকে দুর্বল দেখিয়েছে, কিন্তু সে-ই ছিল আসল খুনি। অর্ণব যখন এই সত্য তাকে সামনে বলল, নন্দিতা একবার হাসল—ঠান্ডা, ফাঁকা, ভয়ঙ্কর এক হাসি।
“ও আমার স্বপ্ন চুরি করেছিল, আমি শুধু আমারটা ফিরিয়ে নিয়েছি।”
অর্ণব চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বাইরে বৃষ্টি নামছিল, জানলার কাঁচে টুপটাপ শব্দ। সত্য বেরিয়ে এসেছে, কিন্তু সেই সত্যও যেন নিজের মতো করে নিঃসঙ্গ।
খুনের রহস্যের সমাধান হয়ে গেছে, কিন্তু শহর এখনো সেই অদ্ভুত নিস্তব্ধতায় মোড়া। কারণ সত্যকে মুখোশ পরাতে আমরা খুব সহজে শিখে গেছি।
Comments
Post a Comment